অজানাকে জানার প্রতি মানুষের আগ্রহ চিরদিনের। মানুষ তার অজানাকে জানার তীব্র কৌতুহল মেটাতে পাড়ি জমায় মুসাফির বেশে শত শত মাইক দূরের দেশে। 

.

এই জাতীয় অজানা বিষয় সম্পর্কে জানার এই অদম্য কৌতুহল ও আকাঙ্খা অনেক সময়ই মানুষকে ভুল পথে ধাবিত করে। কারণ কৌতুহলের বিষয়টি মানুষের সম্পূর্ণ অজানা। আর এই অজানা বিষয়ে সঠিক ও নির্ভুল তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাও অগণিত। অনেক ক্ষেত্রেই স্বার্থান্বেষী মহল সেই তথ্য উপাত্ত উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বিকৃত করে। ফলে অজানাকে জানা আর হয়ে উঠে না, জানা হয় এক বিকৃত ইতিহাসের পাঠ। 

.

প্রতিটি শতাব্দীর এমন কিছু মানুষ থাকে যাদের সম্পর্কে আমাদের জানার আগ্রহ ও কৌতুহল থাকে আকাশচুম্বী। এই কৌতুহল সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত অনেক সময়-ই হয়ে থাকে চরম পক্ষপাতদুষ্ট। এই ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়ার অবদান অভাবনীয়, অচিন্তনীয়। এই সকল মিডিয়া যেন মিথ্যাচারের পসরা সাজিয়ে বসে। এউ সমাজের প্রতিটি সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনার পরিধি ও বিস্তৃতি পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে এই সকল মিডিয়া। একইভাবে একজন মানুষকে সাধারণ মানুষের চোখের শূল বানাতে তাদের জুড়ি মেলা ভার। 

.

চোখের শূল বনে যাওয়া সেই মানুষটি তার জীবদ্দশায় বাস্তবিক অর্থে কেমন ছিল, আর মিডিয়া তাকে কীভাবে উপস্থাপন করেছে তার মধ্যে রয়ে যায় আসমান জমিনের ন্যায় বিশাল ব্যবধান। আরও রয়েছে সত্যের সাথে অগণিত মিথ্যার সংমিশ্রণ। হলুদ মিডিয়া কর্তৃক প্রচার করা সেই মিথ্যাকে যাচাই করার সুযোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে না। কেননা সাধারণ মানুষ সর্বদাই সাধারণ হয়। 

.

এই সকল মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার এরূপ পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ উ সা মা বিন লা দে ন। কিছু বুঝতে পারলেন? না পারাটাই স্বাভাবিক। আমি জোর দিয়েছি মূলত তার নামটার উপর-ই। এই জাতীয় পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়ার চক্রান্তের দরুন একজন মানুষের নামটাও আপনি পরিপূর্ণভাবে লিখতে পারবেন না। এটাই তাদের দ্বিমুখীতা ও স্বেচ্ছাচারি চিন্তাধারার সর্বোত্তম নিদর্শন। 

.

এই নামটি স্বাভাবিকভাবে লিখলে আপনার আইডি রিস্কে পড়ে যেতে পারে, আপনাকে কেউ কেউ স ন্ত্রা স বা দী ট্যাগ দিয়ে দেবে। এমনকি এই নাম উচ্চারণ কিংবা পূর্ণাজ্ঞরূপে লেখার কারণে, কিংবা উপরোক্ত নামের এই মানুষটিকে ইতিবাচকভাবে ব্যাখ্যা করার কারণে ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকেই খারেজী ও জ ঙ্গী তকমাও পেতে হতে পারে। অথচ তাদের কোন ধারণাই নেই মানুষটি সম্পর্কে। আমি অধমের এই বইটি সম্পর্কে ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনকিছু না বলার পরও হয়ত এই জাতীয় ট্যাগ অতিসত্বর হজম করতে হতে পারে। 

.

সত্যি বলতে, এইরূপ ট্যাগাট্যাগি বর্তমান সময়ে মরুভূমিতে প্রবল তৃষ্ণার্তের কাছে পানি পাওয়ার ন্যায় উপযোগ তৈরি করে। এই মুহূর্তে যাদের নুনসহ পানির প্রচুর প্রয়োজন তারা চাইলে ট্যাগ দিতেই পারেন। আমার কিছু যায় আসে না। তবে এইটুকু বলব, অন্তত সেই মহান সত্তার কাছে জবাবদিহি করার ভয় করুন, যার হাতে আমার ও আপনার প্রাণ। 

.

আমাদের তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে আজকাল ভীনদেশীয় টিভি সিরিজের প্রতি এক প্রচণ্ড হিড়িক তৈরি হয়েছে। এই প্রজন্মের একটি দল আছে যারা প্রচণ্ডরকম সিরিজ ভক্ত। এই প্রজন্ম যে জনরার সিরিজ দেখে তার অধিকাংশ হচ্ছে ক্রাইম থ্রিলার। যদিও সেই সিরিজগুলো দেখতে তাদের অন্তরে কোন প্রকার ভাব আবেগ সৃষ্টি না। কিন্তু উপরোক্ত মানুষটির নাম শুনলে তাদের মনে একটি প্রবল নেতিবাচক মনোভাব স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়ে যায়। 

.

যদিও সে অনেক বড় বড় স ন্ত্রা সী, মা ফি য়া, ড্রাগ ডিলার, অস্ত্র ব্যবসায়ী, ইউরেনিয়াম কারবারি, ডা র্ক ওয়েব হিউম্যান ট্রাফিকিংসহ সকল কিছুই স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে মেনে নেয় কিন্তু এই মানুষটি সম্পর্কে সামান্যতম না জেনেও এক পাক্ষিক ও নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। তাদের অনেকে সেই সকল সিরিজ দেখে আবেগী হয়, তার ভালো দিক ও খারাপ দিক নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করে। সেই একই মানুষগুলো আবার কোনো প্রকার ধারণা ছাড়াই তাকে দোষারোপ করে। 

.

আর বাস্তবতা হচ্ছে উপরোক্ত মানুষটাকে নিয়ে অনেকের ক্রেজ নেই। তার নাম শুনলেও নাক সিটকায়, তাদের তার নাম মুখে নিলেও ফেসবুক যেভাবে অন্যকে ব্রাশ করিয়ে দিতে চায়, আমাদের অনেক তরুণও তেমনিভাবে নিজেই ব্রাশ করতে উদ্যত হয়। অথচ তার সম্পর্কে তাদের ন্যুনতম ধারণা, জ্ঞান নেই। সত্যি বলতে আমার নিজেরও মানুষটি সম্পর্কে বিশদ জানাশোনা নেই। এই জন্য তো আমি অন্তত এক পাক্ষিক আচরণ করতে পারি না। এটা অন্যায়। বরঞ্চ তার সম্পর্কে জানার প্রবল আগ্রহ রাখি।

.

আমি আরও বিশ্বাস করি, মানুষটির গোটা জীবন বর্তমান তরুণদের পাথেয় ওয়েব সিরিজের থ্রিলারকে বহুবার হার মানাবে। আমার যখন আরও কিছুটা কম বয়স, যখন আমি জাহিলিয়াতের সময় পার করছিলাম, তখন মাঝে মধ্যেই শুনতাম মানুষটি আর পৃথিবীতে নেই। তাকে শহীদ করে দেয়া হয়েছে। অথচ এর কয়েক দিন পর-ই আবার তার দেখা পেতাম। 

.

শেষবার যেদিন তাকে মেরে সমুদ্রে সমাধি দেয়ার খবর শুনলাম, সেদিন বন্ধুকে বলে বসলাম আরে ক'দিন পরই নতুন কোনো স্টেটমেন্ট নিয়ে হাজির হবে দেখিস। উনাকে তখনও আমি ঠিকভাবে চিনতাম না, জানতাম না। সেই সময়ে নিয়মিত এমন উড়ু খবর শোনার দরুন এমনটা মাথায় গেথে গিয়েছিল। 

.

সত্যি বলতে, সোনার চামচ মুখে জন্ম নেয়া এই মানুষটা নিজেই একটি থ্রিলার মেশিন। এই মানুষটির জীবন জুড়ে রয়েছে আর দশটি সাধারণ মানুষের মতোই প্রিয়জনের প্রতি প্রবল ভালোবাসা, রয়েছে আনন্দ-বেদনা, আবেগ-অনুতাপসহ সকল মানবীয় বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণ। কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা তাকে কীভাবে চিনি? তাকে কতটা জানি? এই সকল পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়া তাকে কীভাবে উপস্থাপন করে? তাকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় আসলে তিনি কী তেমনই? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার জন্য হলেও বইটি পড়া উচিৎ। 

.

আমরা তাকে না চিনলেও তার শত্রুরা তাকে ঠিক চিনেছে। যেন-তেন চেনা নয়, প্রকৃত চেনাই চিনেছে। আফসোস, আমরা অদ্যাবধি তাকে চিনতে পারিনি। অথচ আমরা যেই পরিচয় বিলং করি, তিনিও একই পরিচয় বিলং করেন। তবুও আমরা তার সম্পর্কে জানি না, চিনি না। সত্যি বলতে তার সম্পর্কে আমাদের থেকে অনেক বেশি চেনে পশ্চিমের মানুষজন। 

.

বাস্তবতা হচ্ছে, ৯ এগারোর পর থেকে পশ্চিমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের যে হিড়িক পড়েছে সেটাও তার অবদান। এত কিছুর পরও আমরা তাকে চিনি না, তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখি না। তাকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী সঠিক মূল্যায়ন পর্যন্ত করতে পারি না।   

.

আমরা মূল্যায়ন না করলেও তার শত্রুরা তাকে ঠিক ঠিক চিনেছে, তাকে সমীহ করেছে এবং তার যথাযথ না হলেও কাছাকাছি মূল্যায়ন করতে পেরেছে। আফসোস, নেটিভ হয়েও যেটা আমরা পারিনি। 

.

মানুষটিকে হত্যার নিমিত্তে যু দ্ধ র ত মার্কিন সি আই এ -এর বি ন লা দে ন ডিপার্টমেন্টের প্রধান গোয়েন্দা কর্মকর্তা মাইকেল শ'ইয়ার (মূল বইয়ের লেখক) সামান্য হলেও তার ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন করতে পেরেছেন। অতিরঞ্জন কিংবা মিডিয়ার ন্যায় অতিমাত্রায় পক্ষপাতিত্ব নয়, তিনি বাস্তবে যেমন ছিলেন তেমনভাবেই তাকে প্রকাশ করেছেন বইটির লেখক মাইকেল শ'ইয়ার। তার ব্যাপারে লেখক বইটির উপসংহারে বলেছেন,


"যদিও আমি তাকে হত্যা করতে চাই, কিন্তু আমি স্বীকার করি তিনি একজন সৎ, সাহসী ও মেধাবী শত্রু। আমি তার গুণগুলোকে সম্মান করি।"


অন্য আরেকটি অংশে তিনি বলেছেন,

"প্রকৃতপক্ষে, আমাকে যদি ১০টা গুণে তাকে সংজ্ঞায়িত করতে বলা হতো তবে সেগুলি হতো: ধার্মিক, সাহসী, উদার, বুদ্ধিমান, ক্যারিশম্যাটিক, ধৈর্যশীল, জেদি, সমতাবাদী এবং সর্বোপরি বাস্তববাদী।"

.

শেষ করছি বইটির অনুবাদকের ভাষায় হৃদয় ছোঁয়া একটি উক্তি দিয়ে, "চলুন চিনে আসি সে বীরকে যাকে শত্রু চিনেছে কিন্তু উম্মাহ চিনেনি।"

.

#বিশেষ_নোট: বইটি কোনো ইসলামিক লেখকের লেখা বই নয়। এটি আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন অফিসারের লেখা বই। এটি বইয়ের বাংলা অনুবাদ মাত্র। বক্ষ্যমাণ বইটি না পড়ে, প্রিডিটারমাইন্ড অযাচিত মন্তব্য করে এবং সিলেক্টিভ বক্তব্য দিয়ে নিজ অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না। ধন্যবাদ। 

________________________________

বই: সাম্রাজ্যের ত্রাস 

মূল: মাইকেল শ'ইয়ার

অনুবাদ: Irfan Sadik, নাঈমুর রহমান

পাবলিকেশন: ইঙ্কলাইট

পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৩৪২

________________________________

~ সাবেক কিংকর্তব্যবিমূঢ়