নারীর বিরহে নারীর মিলনে নর পেল কবিপ্রাণ

যত কথা তার হইল কবিতা শব্দ হইল গান।
রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন রাজারে শাসিছে রাণী,
রাণীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্ল­ানি।

মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর স্ত্রী মেহেরুন্নেসার রূপেগুণে মুগ্ধ হয়ে তাঁর নাম দিয়েছিলেন নূর জাহান। আর মোগল সম্রাট শাহজাহান তাঁর স্ত্রী মমতাজ বেগমের স্মৃতি অক্ষুণ্ণ রাখতে স্ত্রীর কবরের উপর জগদ্বিখ্যাত স্মৃতিসৌধ তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন, যা আজও জগদ্বাসীর নিকট দর্শনীয় বস্ত্ত হিসাবে অম্লান রয়েছে। ইতিহাসে উল্লেখিত হয়েছে, বিশ হাযার শ্রমিকের বাইশ বছরের বিরামহীন পরিশ্রমের ফল সেটি। লোকচক্ষুর অন্তরালে এরূপ কতশত মহিয়সী নারী যে রাজ্য শাসনে রাজাকে সঠিক নির্দেশনা দিয়েছেন, তা আমাদের অজানা রয়েছে। একজন জমিদার পত্নীর জীবনী আমাদের কাছে সে অজানা কাহিনীর কিছুটা প্রকাশ করবে।

বাংলাদেশের অধিকাংশ জমিদার প্রজাদের উপর যথেষ্ট অত্যাচার চালিয়েছেন। এরূপ একজন অত্যাচারী ও ব্যভিচারী জমিদারের দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ময়ূর। ময়ূর প্রথমে জমিদারের বৈধ স্ত্রী হিসাবে আসন পায়নি। কিন্তু সে তার যোগ্যতাগুণে বৈধ স্ত্রীর মর্যাদা লাভ করে। ময়ূর অত্যন্ত সুন্দরী কুমারী যুবতী। সে গ্রাম্য মেলা দেখতে গেলে জমিদারের লোকেরা তাকে জোর করে মেলা হ’তে ধরে নিয়ে যায়। জমিদার তার স্বভাবদোষে তার সাথে অবৈধ মিলনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ময়ূর বলে, আপনি আপনার স্বভাব না বদলালে আমি যে কোন মুহূর্তে আত্মহত্যা করব। আমি আমার ইয্যত রক্ষার্থে মরণকে মোটেও ভয় করব না। আপনি আমাকে চাইলে আমার কয়েকটি শর্ত আপনাকে মেনে নিতে হবে।

জমিদার ইতিপূর্বে এরূপ সুন্দরী কোন নারীর সাক্ষাৎ পাননি। আর ময়ূরের মধ্যে যে তেজস্বিতা রয়েছে, এতেও জমিদার মুগ্ধ হন। তাই তিনি তার শর্তগুলি শুনতে চান। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তোমার শর্তগুলি কি কি? ময়ূর বলে, (১) আপনি প্রজাদের উপর অত্যাচার করবেন না (২) আপনি ব্যভিচার করবেন না। মদ পান করবেন না এবং অন্দর মহলে বাইজী এনে নৃত্য-গীত করাবেন না (৩) আপনার অত্যাচারে অত্যাচারিত হয়ে প্রজারা যে মাসঊদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেছিল, সে মাসঊদকে আপনার ক্ষমা করতে হবে।

মানুষ একজন নারীর প্রেমে মুগ্ধ হ’লে তার যথা-সর্বস্ব যে বিলিয়ে দিতে পারে, তার উজ্জ্বল নযীর রেখেছেন অষ্টম এডওয়ার্ড। রাজ পরিবার ছাড়া নিম্ন পরিবারে বিয়ে করলে সিংহাসনের অধিকার হারাতে হবে জেনেও তিনি একজন আইরিশ কৃষক কন্যাকে বিয়ে করেন। সে সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রায় অর্ধেক পৃথিবীব্যাপী বিস্তার লাভ করেছিল। সেক্ষেত্রে তিনি একজন সামান্য জমিদার মাত্র। তাই তিনি ময়ূরের শর্তগুলি দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নিলেন।

ময়ূরের আরোপিত শর্তের কারণে জমিদার এখন আর অত্যাচারী জমিদার নন। তিনি এখন প্রজাবৎসল জমিদার। এখন তিনি একজন সৎ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। তার এরূপ আশাতীত পরিবর্তন মহিয়সী নারী ময়ূরের প্রভাবেই সম্ভব হয়েছে। ইতিপূর্বে প্রজাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করা হয়েছে, তার জন্য তিনি স্ত্রীর পরামর্শে দুই বছরের খাজনা মওকুফের ঘোষণা দিতে আদেশ দেন।কিন্তু সব দেশে সব সময় একদল কুচক্রী লোক থাকে। জমিদারের ম্যানেজার সে কুচক্রী দলের নেতা। এতদিন ধরে যত অপকর্ম তারই পরামর্শে সাধিত হয়েছে। সতীন একজন নারীর কাছে সব সময় বিষ নযরে থাকে। তাই ময়ূর এখন প্রথম স্ত্রীর বিষ নযরের বিষয়বস্ত্ত। ময়ূরকে সরাতে সার্বক্ষণিক তার চিন্তা-ভাবনা। এজন্য সে বুদ্ধ স্বভাবের ম্যানেজারের সাথে হাত মিলিয়েছে। ম্যানেজারও সেটি চায়। ফলে দু’বছরের স্থলে চার বছরের খাজনা মওকুফের ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে ইংরেজ সরকারের কালেক্টরী দেওয়ার ক্ষমতা জমিদারের থাকে না। এছাড়া যে মাসঊদকে ময়ূরের শর্তে জমিদার মাফ করে দিয়েছিলেন, তাকে জড়িয়ে অতি কুৎসিত অভিযোগ অতি সুনিপুণভাবে ম্যানেজার  জমিদারের  সামনে  পেশ  করে।

ময়ূর এখন সন্তান সম্ভবা। সে মাসঊদের পক্ষের বলে ধারণা দেওয়া হয়। ময়ূর এসব অভিযোগ শত চেষ্টা করেও জমিদারের কাছে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে অপারগ হয়। সে আল্লাহর নামে শপথ করে বলে যে, সে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ। অতি কুরুচিকর অভিযোগে জমিদার হঠাৎ করে চরম উত্তেজিত হয়ে স্ত্রীর গলা চেঁপে ধরে শ্বাস রোধে তার মৃত্যু ঘটান। ময়ূরের মৃত্যুর পরপরই জমিদারের কিছু নিম্ন কর্মচারীদের কাছ থেকে আসল ঘটনা প্রকাশিত হয়। ম্যানেজার ও প্রথম স্ত্রীর চক্রান্তও ফাঁস হয়ে যায়। জমিদারের আদেশে তাদের দু’জনকে ধরে অন্ধকার মৃত্যু কূপে নিক্ষেপ করা হয়।

এদিকে ইংরেজ সরকারের কালেক্টরী দেওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে। চার বছরের খাজনা মওকুফের ফলে কালেক্টরী দেওয়া আর সম্ভব হ’ল না। তাছাড়া ময়ূরের মৃত্যুতে জমিদার একেবারে উদাসীন হয়ে পড়েন। জমিদারী ধরে রাখতে তার চরম অনীহা হয়। তিনি জমিদারী ছেড়ে দেন। বাকী জীবন তিনি একজন অতি সাধারণ মানুষের মত অতিবাহিত করেন।