নামঃ অত্যাচারিতের শিক্ষা
লেখকঃ পাওলো ফ্রেইরি
অনুবাদঃ পাঠক সমাবেশ ( আমিনুল ইসলাম ভুইয়া)
(বইটি অত্যন্ত কষ্টপাঠ্য - আহমদ ছফা,১৯৯৫ হাতে সময় নিয়ে ধৈর্য সহকারে পড়ার অনুরোধ রইল)
পাওলো ফ্রেইরির মতে শিক্ষা আর অত্যাচারিতদের ভাগ্য এক সূত্রে গাঁথা , কারণ শিক্ষা যেমন হতে পারে তারদের মুক্তির হাতিয়ার আবার এই শিক্ষার নাগপাশের ফলেই তারা অত্যাচারিত। শিক্ষার অত্যাচারী দর্শন আর মুক্তিদায়ী রূপ অথবা শিক্ষার রাজনৈতিক ব্যবহার অথবা শিক্ষার মাধ্যমে মুক্ত সমাজ সৃষ্টি ফ্রেইরির আলোচ্য বিষয় ।ফ্রেইরি তার শিক্ষা দর্শনের মূল সূত্র আঁকেন শিক্ষার মানবিকরণের মাধ্যমে , প্রকৃত মানবিক শিক্ষা নারী ও পুরুষের নিজের ও নিজের আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে । যে শিক্ষা মানুষকে বিমানবিকরনের দিকে নিয়ে যায় তা মানুষকে বন্দী করে , আটকে ফেলে দাসত্বের শিকলে ,সেই শিক্ষাই অত্যাচারীর হাতিয়ার আর এই শিক্ষার যারা শিকার অর্থাৎ সামাজিক শৃঙ্খলের মাধ্যমে নির্যাতিত ,নিপীড়িত ও বিমানবিকরণের শিকার তারাই অত্যাচারিত । তিনি শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাসী নন বরং তিনি শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের পরিবর্তনে বিশ্বাস করেন , আর এই মানুষেরাই সমাজের পরিবর্তন আনবে । তাই তিনি বলেন , শিক্ষাকে হতে হবে প্রথা ভাঙ্গার হাতিয়ার , সত্যকে জানার হাতিয়ার যার ফলে শিক্ষার্থীদের সচেতনায়ন ও পুনঃসামাজিকীকরণ ঘটবে ও মানবিক মুক্তি ঘটবে অত্যাচারীর হাত থেকে। শিক্ষার মাঝে যে মুক্তির চেতনা লুক্কায়িত আছে তা সমাজের মাঝে ছড়িয়ে দিতে শিক্ষাকে সমাজের চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তনের ও রি-মডেলিং এর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য । ফ্রেইরির এই বইটি সে দিকটাই ইংগিত করে , মুক্তির এই প্রক্রিয়ায় তিনি সংলাপ ধর্মী শিক্ষার কনসেপ্ট নিয়ে আলোচনা করেছেন । সংলাপ-ধর্মী শিক্ষা অত্যাচারী আর অত্যাচারিত উভয় কে তাদের নীতি ও মূল্যবোধের পার্থক্য যথাসম্ভব কমিয়ে তাদের মাঝে এক সেতু তৈরি করে যার মাধ্যমে মুক্তি উন্মেষিত হয় আর বন্দিত্ব দূরীভূত হয় । কিন্তু সংলাপ-ধর্মী শিক্ষার অভাব সমাজের বর্তমান হায়ারার্কি ব্যবস্থার সহায়ক যেখানে অত্যাচারীরা উপরে অবস্থান করে আর অত্যাচারিতরা নিচে অবস্থান করে , উপরের লোক চিন্তা করে নিচের লোকদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে,তাদের মধ্যকার পশুত্ব দূর করে মানবিক করে গড়ে তুলতে হবে যাতে সমাজস্থিত হায়ারার্কি বর্তমান থাকে , আর তাদের সেই শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে নিচে অবস্থিতদের মুক্তির চিন্তা চির বিতাড়িত হয় এবং সবশেষে অত্যাচারিতরাই নতুন অত্যাচারী শ্রেণীতে পরিণত হয় । তথাপি মুক্তির শিক্ষা অথবা শিকল ভাঙ্গার শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা ,যা অত্যাচারিতের জন্য শিক্ষা । তিনি অত্যাচারিতদের নিজেদের লড়াই নিজেদেরই লড়তে উৎসাহিত করেছেন , কারণ যারা অত্যাচারিতদের সাহায্য করতে আসে তারা নিজেরাই অত্যাচারী মনোভাবের অথবা জানেই না কিভাবের মানুষের মুক্তির উত্তম পথ বাতলে দেয়া যায় ।
ফ্রেইরি শিক্ষাদানের প্রচলিত ব্যবস্থাকে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাথে তুলনা করেছেন , ব্যাংকে যেমন কেউ গিয়ে সম্পদ জমা রাখেন তেমনি শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞান জমা রাখেন মাত্র, তিনি এই ব্যবস্থার ঘোরতর বিরোধী ।ফ্রেইরির মতে শিক্ষাদান হবে উভয়-পাক্ষিক । শিক্ষক ও শিক্ষার্থী যেখানে সমান এক বেদীতে অবস্থান কবেন ,তারদের মধ্যে থাকবে সংলাপধর্মী , বোঝাপড়া ও বিশ্বাসের সম্পর্ক । শিক্ষাদানের প্রক্রিয়া হবে চমৎকার এক গণতান্ত্রিক , অংশগ্রহণমূলক ও প্রভাববিস্তারি ।সমস্যা সমাধান মূলক ব্লেনডেড মডেলের মাধ্যমে সমস্যা নির্ধারণ করে শিক্ষার্থীদের উদ্ভাসিত করতে হবে সে সমস্যা সমাধানের জন্য , যেখানে শিক্ষকের ভূমিকা কৌতূহল উদ্দীপক হিসেবে ।সমস্যা নির্ধারণ হবে গণতান্ত্রিক এবং জীবনমুখী ধারণার উপর ভিত্তি করে। কিন্তু অত্যাচারী ব্যবস্থা হচ্ছে ঠিক এর বিপরীত, যেখানে অত্যাচারিতদের বলা হয় “ প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত” “জ্ঞান কুক্ষিগত” এবং সংলাপ বিরোধী । ঠিক যেমন শিক্ষার ব্যাংকিং ব্যবস্থা । এমতাবস্থায় মানবসমাজ শিক্ষার যে বৈপ্লবিক ধাক্কা ,তা অনুভবে অপারগ । সমাজ ও সমাজস্থ হায়ারার্কি ব্যবস্থা থাকে অপরিবর্তিত । অত্যাচারিতরা উচিত শিক্ষার মাধ্যমে আস্তে আস্তে নতুন অত্যাচারী হয়ে উঠে। শিক্ষা হয়ে উঠে বিমানবিকরনের হাতিয়ার।
শিক্ষাব্যবস্থার সংলাপধর্মী আচরণে ফ্রেইরি সংলাপ ও প্রাক্সিসের বা কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের জন্য আচরণের মাধ্যমে মানব মুক্তির প্রয়াস খুঁজেছেন আর মুক্তি বলতে তিনি জানা ,বুঝা , বলার মাধ্যমে নিজের অবস্থার পরিবর্তন করতে পারার স্বাধীনতার কথা বলেছেন । সমগ্র বইয়ে ফ্রেইরি এই সংলাপধর্মীতার কথা বার বার ব্যক্ত করেছেন । তার মতে সংলাপধর্মী আচরণ বিপ্লবী প্রাক্সিস তৈরির প্রাথমিক ও অপরিহার্য যাত্রা । আর সংলাপের প্রধান কিছু অঙ্গ যেমন- প্রত্যাশা ,ভালবাসা আর সমালোচনা ছাড়া সংলাপ স্থায়ী ও সফল হতে পারে না। প্রত্যাশা আর সমস্যা সমাধান মূলক মডেলের মাধ্যমে অত্যাচারিতরা এটা বুঝতে পারে যে তাদের প্রতি অনাচার কোন চিরস্থায়ী কিছু না , পরিবর্তনযোগ্য ব্যাপার । এক্ষেত্রে শিক্ষক কিংবা একজন নেতার কাজ হবে অত্যাচারিত সমাজকে বিপ্লবের দিকে পরিচালিত করা । ফ্রেইরির মতে অত্যাচার যতটা স্থায়ী হয় তার সমাধান ততটাই নিশিত হয় ।যেহেতু সমস্যা প্রদর্শন মূলক মডেলের মাধ্যমে অত্যাচারিত মানুষের চিন্তা চেতনার সাথে তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার সেতুবন্ধন রচিত হয় তাই এর মাধ্যমে এমন বাস্তব সমস্যার আলোচনা করা উচিত যা এই সমাজে বর্তমান , তাহলেই নতুন কোন “বিপ্লবী চিন্তা” বেরিয়ে আসবে । অত্যাচারী সমাজ এই সেতু বন্ধন সৃষ্টিকে যথেষ্ট ভয় পায়, তাই তাদের সৃষ্টি শিক্ষার ব্যাংকিং ব্যবস্থা যার মাধ্যমে শিকল ভাঙ্গার চিন্তাধারা অসম্ভব । ফ্রেইরির মতে ইতিহাসের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন হয় নি , সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যমে ইতিহাস রচিত হয়েছে , যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তাদের চিন্তা চেতনার পরিবর্তন ও সমাজ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত না নেয় , ততক্ষণ পর্যন্ত কোন ইতিহাস রচিত হয় না। তাই শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত উপযুক্ত কারণের তালাশ আর পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত । মানুষ যখন বুঝবে তারা অত্যাচারিত তখন তাদের এটাও ভাবতে হবে তাদের সংগ্রামের কারণ কি ? একজন শিক্ষকের কাজ হবে সে কারণ আস্তে আস্তে অত্যাচারিতদের মনে গোপন থেকে প্রকাশিত করা । আর এই থিমেটিক ইনভেস্টিগেশন হচ্ছে মানবিকরণের সবথেকে জটিল পর্যায় ।
এই সমস্যা সমাধানের জন্য যে প্রক্রিয়া বা একটি কারিকুলাম ডিজাইন এমন হতে হবে যেখানে টার্গেট কমিউনিটির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ পায় অর্থাৎ জীবনমুখী হয় । অংশগ্রহণমূলক মডিউল , অংশগ্রহণকারীদের সমন্বয়ে তৈরি করতে হবে। আবার এই কারিকুলামকে সর্বদা ডাইন্যামিক হতে হবে , প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তিত হবে পারতে হতে হবে । কারিকুলামকে এক-পাক্ষিক সংলাপের হাতিয়ার হতে দিলে তা সমস্যা সমাধানে ভুল পথে যেতে পারে । তাই কারিকুলামের বহুপাক্ষিক রূপ কারিকুলামের সফলতার প্রতীক। সবথেকে বড় কথা তৈরি মডিউলটি যেন অত্যাচারিতদের নিজেদের কথা ভাবতে অনুপ্রাণিত করে।
ফ্রেইরি সংগ্রামরত অত্যাচারীদের লড়াইয়ে সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকাণ্ডের ভূমিকা নিয়ে আলোকপাত করেছেন । তার মতে সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকান্ডের পারস্পারিক বিপররীতধর্মীতা সংলাপ বিরোধিতা এবং ভুল প্রাক্সিসের জন্ম দেয়। ভুল প্রাক্সিসের ফলে অনেক সময় অত্যাচারীরা একটি অন্তঃসার শূন্য লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় । যেমন সাংস্কৃতিক আক্রমণের অর্থার অন্যের ধ্যান ধারনা-বিশ্বাস ও আচার আপন করে নিবার প্রবণতার স্বীকার হওয়া অত্যাচারীরা যে প্রাক্সিস নিয়ে লড়াই করেন তা আসলে অত্যাচারীদের হাতিয়ার, এটা অনেক সময় অত্যাচারিতরা নিজেরাও জানে না । আবার অত্যাচারিতদের মনে অত্যাচারী-গোষ্ঠীর প্রতি একটা ধারনা থাকে যে “ অত্যাচারীরা অত্যাচারিতদের ভালই চান ।সেজন্য তাদের প্রাক্সিস অত্যাচারীতরা আপন করে নিয়ে দ্বিধাবোধ করে না । তাই নিজেদের লড়াই নিজেদের ই লড়তে হয় , লড়াইয়ের সময় অত্যাচারী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের তত্ত্ব ভুল বিজয় অর্জন , নিজেদের মধ্যে বিভক্তি ও অন্যের নিয়ন্ত্রণের নিয়ামক। তাই একজন বিপ্লবী শিক্ষককে এই বিষয়ে অর্থাৎ পপুলিষ্ট নেতাদের প্রাক্সিস সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন থাকতে হয় যেন অত্যাচারীদের প্রোপ্যাগান্ডায় বিপ্লবের ক্ষতি না সধিত হয় । এই থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে পারস্পারিক সংলাপের মাধ্যমে একটি প্রাক্সিস উদ্ভাবন । এজন্য তত্ত্ব তৈরি , সহযোগিতা , সংগঠন তৈরি আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সমন্বয় প্রয়োজন । ফ্রেইরি সংগঠনকে উচ্চ শিক্ষার সাথে তুলনা করেছেন , যার ফলে ঐক্য শুরু হয় আর ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয় । সংগঠন হচ্ছে কার্যকরী সংলাপের আঁতুড়ঘর যা একটি সংস্কৃতি কে অন্য সংস্কৃতির সাথে সংলাপের সমন্বয় করে যা শিক্ষাকে দ্রুত ও সামগ্রিকভাবে মানবিকরণের অর্থাৎ মুক্তির দিকে প্রভাবিত করে।
মুক্তি বা স্বাধীনতার সাথে একটি শিশুর জন্মের তুলনা করা চলে , খুবই বেদনাবিধুর কিন্তু তৎসত্ত্বেও এর পরিণাম বিশ্বসমাজে অন্যতম স্বস্তিদায়ক এক অনুভূতি। অত্যাচারী আর অত্যাচারিতের এই সংগ্রাম সর্বদা চলমান কিন্তু যা দৃশ্যমান নয় তা হচ্ছে নারী কিংবা পুরুষের মানবিকরণের যে অক্লান্ত প্রচেষ্টা। এই সংকট আদতে শিক্ষক শিক্ষার্থী কিংবা রাজনীতিবিদ বা কোন গোষ্ঠীকেন্দ্রিক নয় , এই সংকট সমগ্র মানবতার , এবং সংকট আসলে ততদিন নিরসন হবে না যতদিন না প্রত্যেকটা মানুষের মুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয় ।
এরকম আরো লেখা পড়তে চাইলে
https://rokon-ud-doula.blogspot.com/?m=1
ধন্যবাদ